সন্তান জন্মের পর পরিবর্তিত মানসিক অবস্থার কারণে অনেকে খিটখিটে , বিষন্ন, আর হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। একে মাতৃত্বের নীল সময় , মেটার্নিটি ব্লু বা পোস্টনেটাল ব্লু বলে। শতকরা প্রায় ৫০ থেকে ৬০ ভাগ মা সন্তান জন্মের পর পোস্টনেটাল ব্লু তে ভোগেন। এই সময়টায় মা খুব উদ্বিগ্নতায় আর একাকীত্বে ভোগেন। সাধারণত সন্তান জন্মের তিন দিনের মধ্যে এর লক্ষণ শুরু হয় , পঞ্চম দিনে তা চরম আকার ধারণ করে এবং পরবর্তী ১০-১২ দিনে ধীরে ধীরে বিষন্নতা কাটিয়ে মা আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠেন।

পোস্ট-নেটাল ব্লু কীঃ
পোস্ট নেটাল ব্লু এক ধরণের মানসিক বিপর্যস্ততা বা মেন্টাল ডিজঅর্ডার। এটি কোনো মানসিক রোগ নয়। সন্তান হওয়ার পরবর্তী সময়ে একজন মায়ের তিন ধরণের মেন্টাল ডিসঅর্ডার হতে পারে, যেমন-
১) পোস্ট নেটাল ব্লু,
২) পোস্ট নেটাল ডিপ্রেশন ও
৩) পিউপেরাল সাইকোসিস।
এদের মধ্যে পোস্ট -নেটাল সবচেয়ে কমন এবং এটি খুব একটা মারাত্বক নয়। তবে “ব্লু” বা নীল সময় ১০-২ দিনের মধ্যে কেটে যায়। তবে দুই সপ্তাহের বেশি এই সমস্যা থাকলে সতর্ক হতে হবে। কেননা এটি পিউপেরাল মেন্টাল ডিজর্ডারের পরবর্তী পর্যায় ডিপ্রেশন বা সাইকোসিসের দিকে মোড় নিতে পারে।
আসুন আমরা জেনে নি-ই এই ব্লু কেনো হয়ঃ
প্রসবের পর রক্তে ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন হরমোনের হটাত পরিবর্তন কে এর কারণ বলে মনে করা হয়। তবে সবার ক্ষেত্রে যে এমনটা হবে তা নয়।
যারা প্রথম মা হন তাদের পক্ষে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের সাথে নিজেদের মানিয়ে নেয়াটা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে।
- প্রসব -পরবর্তী রক্তপাত,বাচ্চা সামলানো,
- বুকের দুধ খাওয়ানোর দায়িত্ব,
- রাতে ঠিকমত ঘুমুতে না পারা ,
- সময় মত বিশ্রাম নিতে না পারা,
- স্বামীর সাথে শারীরিক দূরত্ব ,
- আত্বীয়-স্বজন এলে তাদেরকে অ্যাটেন্ড করা
সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় মা কে।
- তাছাড়া অনেক সময় আত্বীয় স্বজনেরা সন্তান সম্পর্কে নানা রকম বিরুপ মন্তব্য করেন,যা এই সময় মায়ের জন্য খুব তিক্তকর।

- অনেক মা সন্তান হওয়ার ফলে স্বাভাবিক শারীরিক পরিবর্তন গুলোকে সহজভাবে গ্রহন করতে পারেন না এবং এই পরিবর্তনের ফলে তার সৌন্দর্য কমে গিয়েছে বলে মনে করেন।
- সৌন্দর্য কমে যাবার ফলে স্বামী তাকে আগের মত ভালোবাসবে কি না,
- স্বামীর কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে কি না এসব নিয়ে মা ভেতরে ভেতরে ভীষণ দ্বিধাগ্রস্ত ও চিন্তিত হয়ে পড়েন।
মোটকথা সবকিছু মিলিয়ে মা হয়ে পড়েন ভীষণ বিপন্ন আর একা। তার এই একাকীত্ব , তার এই কষ্ট তিনি কারো সাথে শেয়ার করতে না পেরে নিজে নিজে কষ্ট পান এবং বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

এই সময়ে যা করনীয়ঃ
পোস্ট নেটাল ব্লুর বিশেষ কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। এই স্পর্শ কাতর সময়ে নতুন মায়ের দরকার সঠিক যত্ন, সঙ্গ , মনোযোগ ও সহানুভূতি । নতুন শিশু, বিপর্যস্ত পরিস্থিতি, পরিবর্তিত শরীর নিয়ে মা থাকে ভীষন বিব্রত।
তাকে বোঝাতে হবে এই পরিবর্তন খুব-ই স্বাভাবিক ও সাময়িক । নিয়মিত যত্ন ও ব্যায়াম তাকে আগের শারীরিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। এই সময়ে মা কে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে হবে। তাকে আশ্বস্ত করতে হবে। মা যাতে তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারে এবং বাচ্চার ও নিজের যত্ন নিতে পারে সে ব্যাপারে সহযোগিতা করতে হবে।

চট করে রেগে গেলে , যখন তখন কান্না করলে তার প্রতি বিরক্তি প্রকাশ না করে, তাকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। পর্যাপ্ত সংগ দিতে হবে।
মায়ের এই অসহায় মুহুর্তে তিনি খুব মনযোগ প্রত্যাশা করেন- বিশেষ করে স্বামী ও আপনজনদের কাছ থেকে। তার প্রতি মনোযোগী হতে হবে, গুরুত্ব দিতে হবে। এই সমস্যা কে অবহেলা করলে তা গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে। যা অনেক সময় সংসারে অশান্তি ডেকে আনে।

কাজেই ওষুধ নয় , স্বামী ও পরিবারের সদস্য দের খোলামেলা আলোচনা, পর্যাপ্ত সঙ্গ দান ও সহযোগীতাপূর্ণ মনোভাব মাতৃত্বের এই নীল সময় কাটিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট ।